হালের অন্যতম জনপ্রিয় নির্মাতা কাজল আরেফিন অমি। তবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি অমি’র সমালোচনাও কম নয়। অনেকের অভিযোগ, অমি’র নির্মাণে চটুলতা বেশি। তবে এবার সমালোচকদের আর সেটি বলার যে সুযোগ নেই সেটি এক বাক্যেই বলে দেওয়া।
সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বঙ্গ’তে মুক্তি পেয়েছে ওয়েব ফিল্ম “অসময়”। যেখানে তথাকথিত “চটুলতার” বাইরে গিয়ে দেখা মিলেছে সিরিয়াস এক অমির। তবে সিরিয়াস গল্প বলতে গিয়েও অমি তার নিজস্ব ঘরানার বাইরে যাননি।
কাজল আরেফিন অমি’র বেশিরভাগ নির্মাণে থাকে আমাদের চারপাশের ঘটমান জীবনের গল্প। থাকে তারুণ্যের প্রাধান্য, থাকে দর্শকদের হাসানোর অসংখ্য উপাদান। “অসময়” ওয়েব ফিল্মেও ছিল অমির পরিচিত সব উপকরণ। শুধু পরিবেশনটা ছিল আগের যেকোনো নির্মাণের চেয়ে আলাদা। তাই “অসময়” দেখার পর কট্টর সমালোচকও প্রশংসা করতে বাধ্য।
“অসময়” এর রচনা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা সবটাই করেছেন কাজল আরেফিন অমি। গুণী এই নির্মাতা তার প্রথাগত বৈশিষ্ট্যে আমাদের সমাজের চলমান ঘটনা অসাধারণ সাবলীলতায় তুলে ধরেছেন। আর এই ওয়েব ফিল্মের অন্যতম শক্তিশালী দিক এর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
তারিক আনাম খান, তাসনিয়া ফারিণ, ইরেশ জাকের, শরাফ আহমেদ জীবন, রুনা খান, ইন্তেখাব দিনারের মতো গুণী শিল্পীরা যেন “অসময়” এর পর্দায় অভিনয়ে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিলেন।
“অসময়” এর গল্প গড়ে উঠেছে চলমান সময়ের সমান্তরালে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভোগ-বিলাস, শো-অফ ও স্বার্থপরতাকে কেন্দ্র করে।
গল্পে দেখা যায়, ছোট পদে সরকারি চাকরি করা বাবার মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান উর্বি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ভর্তি হন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। জমি বিক্রি করে তাকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান বাবা। ভর্তি হওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সাধাসিধে জীবনযাপন করা উর্বির জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। এক বন্ধুর জন্মদিন উদযাপনে রাতে বাসার বাইরে থাকার জন্য গ্রুপ স্টাডির মিথ্যা কথা বলে সে। রাতে বাইরে বন্ধুর সঙ্গে থাকাকালে ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। বন্ধুর ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। বুন্ধকে বাঁচাতে গিয়ে এক হামলকারীকে ধাক্কা দেয় সে। এ সময় রাস্তা দিয়ে চলমান একটি ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যায় ওই হামলাকারী। হত্যা মামলা হয় উর্বির নামে। আর এখান থেকেই বদলে যেতে থাকে তার বন্ধু, স্বজন, প্রতিবেশীদের মনোভাব। অসময়ে সবাই সরে যেতে থাকে দূরে। আবার কেউ কেউ ত্রাতা হয়ে দাঁড়ায় পাশে।
একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের অসময়ের গল্পের পাশাপাশি নির্মাতা তুলে ধরেছেন একটি উচ্চবিত্ত পরিবারের জীবনযাপনও। যেখানে বাবা-মায়ের কলহ সন্তানের মননকে প্রভাবিত করার বিষয়টিও উঠে এসেছে সুনিপুণভাবে। একইসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে ক্ষমতাবানদের চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব। উঠে এসেছে মানুষের অসময়ের সুযোগ নিয়ে অন্যের কটাক্ষ করার অসুস্থ প্রবণতা।
এই ওয়েব ফিল্মের গল্প ছুঁয়ে গেছে দর্শকদের হৃদয়। সিরিয়াস গল্পের পাশাপাশি অমি’র চিরায়ত হাসির রসদও ছিল “অসময়”-এ। উর্বির বাবা-মায়ের চরিত্রে তারিক আনাম খান ও মুনিরা মিঠুর দুর্দান্ত অভিনয় দর্শকদের যেমন কাঁদিয়েছে; পাশাপাশি হাসিয়েছে সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মকর্তা চরিত্রে শরাফ আহমেদ জীবন ও ইরেশ জাকের জুটির অদ্ভুত রসায়ন।
আইনজীবীর ভূমিকায় আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন রুনা খান। পাশাপাশি পারিবারিক জীবনের দৃশ্যে ইন্তেখাব দিনারের সঙ্গে তার একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়া অভিনয় ছিল নজরকাড়া। উর্বি চরিত্রে তাসনিয়া ফারিণের অভিনয় ছড়িয়েছে মুগ্ধতা।
পাশাপাশি শাহেদ আলী, শাশ্বত দত্ত, শিমুল শর্মা, লামীমা লাম, ইসরাত জাহিন আহমেদ, সুমন পাটোয়ারী প্রমুখ যার যার চরিত্রে ছিলেন অনবদ্য। ক্ষণিকের উপস্থিতিতে নিজেকে চমৎকারভাবে মেলে ধরেছেন জিয়াউল হক পলাশ।
তবে অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, দুর্দান্ত সংলাপ, চমৎকার কালার গ্রেডিং এবং দারুণ সব আবহ সঙ্গীতের পাশাপাশি “অসময়” নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলার জায়গাও অবশ্য রয়েছে। এই ওয়েব ফিল্মে পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে ইরেশ জাকের এবং সাংবাদিক চরিত্রে শরাফ আহমেদ জীবন জুটির মাধ্যমে দর্শকদের হাসাতে গিয়ে কিছু কিছু দৃশ্য এমন দুটি পেশার সঙ্গে; বিশেষ করে সিরিয়াস একটি ঘটনার তদন্তের সঙ্গে বেমানান লেগেছে। যেমন; গাড়ি থেকে ক্যামেরা চুরির দৃশ্যে ইরেশ জাকেরের ভূমিকা ছিল দৃষ্টিকটূ। এছাড়া শুরুর দিকে সবকিছু অনেক গোছানো থাকলেও পরে গিয়ে মনে হয়েছে শেষ করার জন্য বড্ড তাড়াহুড়ো ছিল নির্মাতার। এমনকি আদালত থেকে উর্বির খালাস পাওয়ার ক্ষেত্রে কাউকে ধাক্কা দেওয়ার ফলে মৃত্যু ঘটলে তাকে কীভাবে পুরোপুরি নির্দোষ ঘোষণা করা যায়; সে বিষয়েও একটু আইনি ব্যাখা দেওয়া প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্মাতা সেটি করেননি। তাই, শেষ দিকে আরকেটু টানটান উত্তেজনা প্রত্যাশিত হলেও দর্শক সেটি থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
“ব্যাচেলর পয়েন্ট” খ্যাত নির্মাতার অন্যান্য সিরিজে বন্ধুত্বের রসায়ন যেভাবে জমে ওঠে “অসময়”-এ সেটি ততটা জমে ওঠেনি। তবে সর্বোপরি, নির্মাতা, রচয়িতা ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে “অসময়” কাজল আরেফিন অমি’র অন্যতম সেরা নির্মাণ, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই।